Saturday, January 17, 2015

গীবত ও গীবতকারীর পরিণতি

      

              

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

ইসলাম ঐক্যবদ্ধ থাকার গুরুত্বারোপ করেছে। ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টকারী সমুদয় কর্ম হতে বিরত থাকতে সকলকে তাগীদ দিয়েছে। সমাজে যেসব বিষয়ে ফাটল ধরাতে এবং ঐক্যের সুরম্য প্রাসাদকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে সক্ষম এমন বিষয়গুলির অন্যতম হল পরনিন্দা বা গীবত। এর মাধ্যমেই শয়তান সমাজে ফাটল ধরিয়ে থাকে। আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেনঃ পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ। [সূরা হুমাযাহ – ০১] কুরআন ও হাদিসে এই আচরণ সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

গীবত-এর সংজ্ঞাঃ ‘গীবত’ অর্থ বিনা প্রয়োজনে কোন ব্যক্তির দোষ অপরের নিকটে উল্লেখ করা। ইবনুল আছীর বলেনঃ “গীবত হল কোন মানুষের এমন কিছু বিষয় যা তার অনুপস্থিতিতে উল্লেখ করা, যা সে অপছন্দ করে, যদিও তা তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে”। এসব সংজ্ঞা মূলত হাদিস হতে নেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) গীবতের পরিচয় দিয়ে বলেনঃ “গীবত হল তোমার ভাইয়ের এমন আচরণ বর্ণনা করা, যা সে খারাপ জানে”।[1]

গীবত করার পরিণামঃ গীবত কবীরা গুনাহ্‌র অন্তর্ভুক্ত। গীবতের পাপ সুদ অপেক্ষা বড়; বরং হাদিসে গীবতকে বড় সুদ বলা হয়েছে (সহীহ আত্‌ তারগীব) রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)-এর নিকটে আয়েশা (রা) ছাফিইয়া (রা)-এর সমালোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ হে আল্লাহ্‌র রাসূল (সা)! আপনার জন্য ছাফিইয়ার এরকম এরকম হওয়াই যথেষ্ট। এর দ্বারা তিনি ছাফিইয়ার বেঁটে সাইজ বুঝাতে চেয়েছিলেন। এতদশ্রবণে নাবী কারীম (সা) বললেনঃ “হে আয়েশা! তুমি এমন কথা বললে, যদি তা সাগরের পানির সঙ্গে মিশানো যেত তবে তার রং তা বদলে দিত”।[2]

১. গীবত জাহান্নামে শাস্তি ভোগের কারণঃ রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) বলেনঃ “মিরাজ কালে আমি এমন কিছু লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখগুলি পিতলের তৈরি, তারা তা দিয়ে তাদের মুখমণ্ডল ও বক্ষগুলিকে ছিঁড়ছিল। আমি জিজ্ঞাস করলাম, এরা কারা হে জিবরীল? তিনি বললেনঃ এরা তারাই যারা মানুষের গোশত খেত এবং তাদের ইজ্জত-আবরু বিনষ্ট করত”।[3]

২. গীবত মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার শামিলঃ আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেনঃ ‘তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে, তোমাদের কেউ কি চায় যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে? তোমরা তো এটাকে ঘৃণাই করে থাকো’। [সূরা হুজুরাত – ১২] অত্র আয়াত প্রমাণ করে যে, গীবত করা মৃত ব্যক্তির গোশত ভক্ষণ করার শামিল।

আনাস ইবন মালেক (রা) বলেনঃ আরবরা সফরে বের হলে একে অপরের খেদমত করত। আবু বকর ও ওমর (রা)-এর সাথে একজন খাদেম ছিল। (একবার সফর অবস্থায়) ঘুম থেকে তারা উভয়ে জাগ্রত হয়ে দেখেন যে, তাদের খাদেম তাদের জন্য খানা প্রস্তুত করেনি, তখন তারা পরস্পরকে বললেন, দেখ এই ব্যক্তিটি বাড়ির ঘুমের ন্যায় ঘুমাচ্ছে (অর্থাৎ এমনভাবে নিদ্রায় বিভোর যে, মনে হচ্ছে সে বাড়িতেই রয়েছে, সফরে নয়)। অতঃপর তারা তাকে জাগিয়ে দিয়ে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)-এর কাছে যাও এবং বল আবু বকর ও ওমর আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং আপনার কাছে তরকারী চেয়ে পাঠিয়েছেন (নাস্তা খাওয়ার জন্য)। লোকটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকটে গেলে তিনি [রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)] বললেনঃ তারাতো তরকারী খেয়েছে, তখন তারা বিস্মিত হলেন এবং নাবী কারীম (সা)-এর নিকটে এসে বললেনঃ হে আল্লাহ্‌র রাসূল (সা)! আমরা আপনার নিকটে এসে লোক পাঠালাম তরকারী তলব করে, অথচ আপনি বলেছেন, আমরা তরকারী খেয়েছি? তখন নাবী কারীম (সা) বললেনঃ তোমরা তোমাদের ভাইয়ের (খাদেমের) গোশত খেয়েছ। কসম ঐ সত্তার! যার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয়ই আমি ঐ খাদেমটির গোশত তোমাদের সামনের দাঁতের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। তারা বললেনঃ [ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)] আপনি আমাদের জন্য ক্ষমা তলব করুন। আলবানী হাদিসটিকে সহিহ্‌ বলেছেন।[4]

আব্দুল্লাহ্‌ ইবন মাসউদ (রা) বলেনঃ (একদা) আমরা নাবী কারীম (সা)-এর নিকটে ছিলাম। এমতাবস্থায় একজন ব্যক্তি উঠে চলে গেল। তার প্রস্থানের পর একজন তার সমালোচনা করল। তখন রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) তাকে বললেনঃ তোমার দাঁত খিলাল কর। লোকটি বললঃ কি কারণে দাঁত খিলাল করব? আমিতো কোন গোশত ভক্ষণ করিনি। তখন তিনি বললেনঃ নিশ্চয়ই তুমি তোমার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করেছ অর্থাৎ ‘গীবত’ করেছ।[5]

গীবত কবরে শাস্তি ভোগের অন্যতম কারণঃ

একদা রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি থমকে দাঁড়ালেন এবং বললেনঃ ‘এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে তাদেরকে তেমন বড় কোন অপরাধে শাস্তি দেওয়া হচ্ছেনা (যা পালন করা তাদের পক্ষে কষ্টকর ছিল)। এদের একজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, চুগলখোরী করার কারণে এবং অন্যজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে পেশাবের ব্যাপারে অসতর্কতার কারনে।[6] অপর হাদিসে চুগলখোরীর পরিবর্তে গীবত করার কথা উল্লেখ রয়েছে।[7]

[1] মুসলিম #১৮০৩

[2] আবূ দাউদ, তিরমিযী, হাদিস সহীহ্‌, সহীহুল জামে #৫১৪০; মিশকাত #৪৮৪৩

[3] আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস সহীহ্‌।

[4] দ্রষ্টব্য আমাসিক আলায়কা লিসানাকা (কুয়েত ১ম সংস্করণ ১৯৯৭ইং)

[5] ত্বাবারানী, ইবন আবী শায়বা, হাদিস সহীহ্‌ দ্রষ্টব্য গায়াতুল মারাম #৪২৮

[6] বুখারী, মুসলিম, সহিহ্‌ আত-তারগীব #১৫৭

[7] আহমাদ প্রভৃতি, সহিহ্‌ আত-তারগীব #১৬০ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়।

Unknown

Author & Editor

Has laoreet percipitur ad. Vide interesset in mei, no his legimus verterem. Et nostrum imperdiet appellantur usu, mnesarchum referrentur id vim.

0 comments:

Post a Comment

0
      

              

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

ইসলাম ঐক্যবদ্ধ থাকার গুরুত্বারোপ করেছে। ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টকারী সমুদয় কর্ম হতে বিরত থাকতে সকলকে তাগীদ দিয়েছে। সমাজে যেসব বিষয়ে ফাটল ধরাতে এবং ঐক্যের সুরম্য প্রাসাদকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে সক্ষম এমন বিষয়গুলির অন্যতম হল পরনিন্দা বা গীবত। এর মাধ্যমেই শয়তান সমাজে ফাটল ধরিয়ে থাকে। আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেনঃ পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ। [সূরা হুমাযাহ – ০১] কুরআন ও হাদিসে এই আচরণ সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

গীবত-এর সংজ্ঞাঃ ‘গীবত’ অর্থ বিনা প্রয়োজনে কোন ব্যক্তির দোষ অপরের নিকটে উল্লেখ করা। ইবনুল আছীর বলেনঃ “গীবত হল কোন মানুষের এমন কিছু বিষয় যা তার অনুপস্থিতিতে উল্লেখ করা, যা সে অপছন্দ করে, যদিও তা তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে”। এসব সংজ্ঞা মূলত হাদিস হতে নেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) গীবতের পরিচয় দিয়ে বলেনঃ “গীবত হল তোমার ভাইয়ের এমন আচরণ বর্ণনা করা, যা সে খারাপ জানে”।[1]

গীবত করার পরিণামঃ গীবত কবীরা গুনাহ্‌র অন্তর্ভুক্ত। গীবতের পাপ সুদ অপেক্ষা বড়; বরং হাদিসে গীবতকে বড় সুদ বলা হয়েছে (সহীহ আত্‌ তারগীব) রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)-এর নিকটে আয়েশা (রা) ছাফিইয়া (রা)-এর সমালোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ হে আল্লাহ্‌র রাসূল (সা)! আপনার জন্য ছাফিইয়ার এরকম এরকম হওয়াই যথেষ্ট। এর দ্বারা তিনি ছাফিইয়ার বেঁটে সাইজ বুঝাতে চেয়েছিলেন। এতদশ্রবণে নাবী কারীম (সা) বললেনঃ “হে আয়েশা! তুমি এমন কথা বললে, যদি তা সাগরের পানির সঙ্গে মিশানো যেত তবে তার রং তা বদলে দিত”।[2]

১. গীবত জাহান্নামে শাস্তি ভোগের কারণঃ রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) বলেনঃ “মিরাজ কালে আমি এমন কিছু লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখগুলি পিতলের তৈরি, তারা তা দিয়ে তাদের মুখমণ্ডল ও বক্ষগুলিকে ছিঁড়ছিল। আমি জিজ্ঞাস করলাম, এরা কারা হে জিবরীল? তিনি বললেনঃ এরা তারাই যারা মানুষের গোশত খেত এবং তাদের ইজ্জত-আবরু বিনষ্ট করত”।[3]

২. গীবত মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার শামিলঃ আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেনঃ ‘তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে, তোমাদের কেউ কি চায় যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে? তোমরা তো এটাকে ঘৃণাই করে থাকো’। [সূরা হুজুরাত – ১২] অত্র আয়াত প্রমাণ করে যে, গীবত করা মৃত ব্যক্তির গোশত ভক্ষণ করার শামিল।

আনাস ইবন মালেক (রা) বলেনঃ আরবরা সফরে বের হলে একে অপরের খেদমত করত। আবু বকর ও ওমর (রা)-এর সাথে একজন খাদেম ছিল। (একবার সফর অবস্থায়) ঘুম থেকে তারা উভয়ে জাগ্রত হয়ে দেখেন যে, তাদের খাদেম তাদের জন্য খানা প্রস্তুত করেনি, তখন তারা পরস্পরকে বললেন, দেখ এই ব্যক্তিটি বাড়ির ঘুমের ন্যায় ঘুমাচ্ছে (অর্থাৎ এমনভাবে নিদ্রায় বিভোর যে, মনে হচ্ছে সে বাড়িতেই রয়েছে, সফরে নয়)। অতঃপর তারা তাকে জাগিয়ে দিয়ে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)-এর কাছে যাও এবং বল আবু বকর ও ওমর আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং আপনার কাছে তরকারী চেয়ে পাঠিয়েছেন (নাস্তা খাওয়ার জন্য)। লোকটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকটে গেলে তিনি [রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)] বললেনঃ তারাতো তরকারী খেয়েছে, তখন তারা বিস্মিত হলেন এবং নাবী কারীম (সা)-এর নিকটে এসে বললেনঃ হে আল্লাহ্‌র রাসূল (সা)! আমরা আপনার নিকটে এসে লোক পাঠালাম তরকারী তলব করে, অথচ আপনি বলেছেন, আমরা তরকারী খেয়েছি? তখন নাবী কারীম (সা) বললেনঃ তোমরা তোমাদের ভাইয়ের (খাদেমের) গোশত খেয়েছ। কসম ঐ সত্তার! যার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয়ই আমি ঐ খাদেমটির গোশত তোমাদের সামনের দাঁতের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। তারা বললেনঃ [ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)] আপনি আমাদের জন্য ক্ষমা তলব করুন। আলবানী হাদিসটিকে সহিহ্‌ বলেছেন।[4]

আব্দুল্লাহ্‌ ইবন মাসউদ (রা) বলেনঃ (একদা) আমরা নাবী কারীম (সা)-এর নিকটে ছিলাম। এমতাবস্থায় একজন ব্যক্তি উঠে চলে গেল। তার প্রস্থানের পর একজন তার সমালোচনা করল। তখন রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) তাকে বললেনঃ তোমার দাঁত খিলাল কর। লোকটি বললঃ কি কারণে দাঁত খিলাল করব? আমিতো কোন গোশত ভক্ষণ করিনি। তখন তিনি বললেনঃ নিশ্চয়ই তুমি তোমার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করেছ অর্থাৎ ‘গীবত’ করেছ।[5]

গীবত কবরে শাস্তি ভোগের অন্যতম কারণঃ

একদা রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি থমকে দাঁড়ালেন এবং বললেনঃ ‘এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে তাদেরকে তেমন বড় কোন অপরাধে শাস্তি দেওয়া হচ্ছেনা (যা পালন করা তাদের পক্ষে কষ্টকর ছিল)। এদের একজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, চুগলখোরী করার কারণে এবং অন্যজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে পেশাবের ব্যাপারে অসতর্কতার কারনে।[6] অপর হাদিসে চুগলখোরীর পরিবর্তে গীবত করার কথা উল্লেখ রয়েছে।[7]

[1] মুসলিম #১৮০৩

[2] আবূ দাউদ, তিরমিযী, হাদিস সহীহ্‌, সহীহুল জামে #৫১৪০; মিশকাত #৪৮৪৩

[3] আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস সহীহ্‌।

[4] দ্রষ্টব্য আমাসিক আলায়কা লিসানাকা (কুয়েত ১ম সংস্করণ ১৯৯৭ইং)

[5] ত্বাবারানী, ইবন আবী শায়বা, হাদিস সহীহ্‌ দ্রষ্টব্য গায়াতুল মারাম #৪২৮

[6] বুখারী, মুসলিম, সহিহ্‌ আত-তারগীব #১৫৭

[7] আহমাদ প্রভৃতি, সহিহ্‌ আত-তারগীব #১৬০ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়।

Post a Comment

Dear readers, after reading the Content please ask for advice and to provide constructive feedback Please Write Relevant Comment with Polite Language.Your comments inspired me to continue blogging. Your opinion much more valuable to me. Thank you.

 
biz.